একাগ্র

একাগ্র
AN OPEN PLATFORM FOR BENGALI LITERATURE

গল্প সমূহ

 

গল্পঃ জীর্ণ পত্র    লেখকঃ ভাস্কর পাল



 

জীর্ণ পত্র 


বৈকালের মেঘ যেন জলধির উপর পড়িয়া এক স্নিগ্ধতার চাদর বিস্তীর্ণ করিয়াছে। তাহা বুঝিতে পারিতাম নাহ্, যদি রৌদ্র ভাবিয়া ঘরে বসিয়া থাকিতাম আকাশ পানে চাহিয়া। হঠাৎ এক বিষণ্ণ হাওয়া যেন বহিয়া গেল বুকের স্পন্দনগুলি নাড়িয়া। আর বাহির হইয়া পড়িলাম আমার ব্যাগখানি কাঁধে লইয়া। এই ব্যাগের রহস্য বড্ডো জটিল। ব্যাগ বলিলে ভুল হইবে,"ইহাতে গোছানো মোর অর্ধ-ভঙ্গিত সংসার..." সংসার নামক বাঁধনে সে কভু বাঁধিতে চায় না আমায়। কেবল বাঁধিতে চাহিয়াছিল এক জীর্ণ পত্রে। যে পত্র জীর্ণ, তবুও প্রাণ আছে তাহার। যে পত্রে লেখা চলে, যাহা পূর্ণতা পায় না কেবল। যে পত্র শুকায় যাইবে, চিহ্ন থাকিবে না তাহার। ইহা জানিয়াও তাহাতে আমি বাঁধিয়া ছিলাম তাহার সহিত।

যাহাই হোক, সেই ব্যাগের কথায় মনে পড়িয়া গেল। সেই ব্যাগ আনা হইয়াছিল সুদূর শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা হইতে। তাহার চোখে প্রেমিক হিসেবে একটা নামই ভাসিয়া ওঠে। সেই আঁখিতে ধোঁয়াশা দিয়া নিজের স্থান করিয়া লইতে আমার বেশি সময় লাগে নাই। সেই ব্যাগে থাকিত একটি মোটা সাদা খাতা। তাহার কথায় সাদায় যাহাই লেখা হোক না কেন তাহা হৃদয়ে শান্তি লইয়া আসে, তাই মন খারাপির হিজিবিজি দাগ কাটিলেও তাহাও নাকি ছন্দ স্বরূপ হইয়া ধরা দেয়। সেই ব্যাগে ছিল একটা কালো কালির কলম এবং একগুচ্ছ ছেঁড়া পাতা। ছেঁড়া পাতায় লিখিতে আমার বেশ লাগিত। তাহার সহিত যখন বসিয়া থাকিতাম নদী তটে কিংবা বৃক্ষ ছায়ায়, তখন সেই ছেঁড়া পাতায় কাব্য বাঁধিতাম তারে লইয়া এবং তাহা যত্ন করিয়া লইয়া যাইত তাহার সহিত। আর ছিল এক বাক্স সিগারেট, যাহা কেবল নেশা দ্রব্য রূপেই ব্যাগে থাকিত না, তাহা স্মৃতি বহন করিবার তরে থাকিত। আমি কভু নেশা করি নাই। সে যখন ইহা দিয়াছিল, তখন বলিয়াছিলাম, "ইহা নেশা দ্রব্য, ইহা লইয়া কি করিব? আমি তো কখনও সিগারেট খাই নাই?"

সে বলিয়াছিল, "ইহা রাখিয়া দিও তোমা কাছে, যাহা দেখিয়া মনে থাকিবে কভু যেন নেশা না করা হয়, আমি নেশা করা পছন্দ করি না।"

ইহার স্বরূপ আমি বলিয়াছিলাম, "আমি তোমারে লইয়া কবিতা বাঁধিব, এবং তাহা জীর্ণ পত্রে স্থান দেবো। কবিতা লইয়া নেশা করিব।"

ইহাই সকল ব্যাগের সম্বল। সে ব্যাগ লইয়াই বাহির হই মাঝে মধ্যে, যাই কোনো নদী তটে কিংবা নির্জনে। আমার একা বাহির হইতে ভালো লাগিত না। তাহার সহিত বাহির হইতে বেশ লাগিত, বিশেষ করিয়া কাব্য বাঁধিতে কোনো নির্জনে। কিন্তু এখন সে নাই; ব্যাগটারে সঙ্গী বানাইয়াছি। আজ এই জীর্ণ পত্র শেষ হইতে চলিতেছে। সকাল হইতেই তারে লইয়া কবিতা পাতিয়াছি। বাড়িতে বসিয়া লিখিতে ইচ্ছা করে না। তাই এই নির্জন জলধির পাশে বসিয়াছি। এই স্থানেই প্রথম তাহার সহিত এক বিষণ্ণ বৈকালে আসিয়া, তাহারে লইয়া কবিতা লিখেছিলাম। শেষ কবিতাও এই স্থানেই। বিগত তিন বর্ষ তাহারে সম্মুখে না দেখিয়াই লিখিয়া চলিতেছি। বলিয়াছিলাম, জীর্ণ পত্র ভরিয়া দেবো তারে লইয়া। এই পুস্তক লেখা শেষ হইলে তাহার হাতে তুলিয়া দেব। আজ শেষ কবিতাটি লিখিতেছি। আজ হয়তো সে নিতে আসিবে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ